গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে আন্তর্জাতিক দিবস আজ। এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের হিসাবে, গত ১৩ বছরে গুমের শিকার ৬২৩ জন।
পুরান ঢাকার বংশালের মো. সোহেল যখন নিখোঁজ হন, তখন তাঁর মেয়ে সাফার বয়স ছিল মাত্র ২ মাস। সাফার বয়স এখন ১০ বছর, তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ছে। বাচ্চাদের অনেকে বাবার হাত ধরে স্কুলে যায়, বাবাকে নিয়ে গল্প বলে। সাফা বাসায় ফিরে প্রশ্ন করে বাবা কোথায়? বায়না ধরে, বাবার সঙ্গে স্কুলে যাবে। উত্তর দিতে পারেন না সাফার মা নিলুফার ইয়াসমিন।
সোহেল বংশাল থানা ছাত্রদলের সভাপতি ছিলেন। ২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর ঢাকার শাহবাগ থেকে আরও তিনজনসহ নিখোঁজ হন তিনি। নিলুফার ইয়াসমিনের অভিযোগ, ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের দুই সপ্তাহ আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এঁদের ধরে নিয়ে যায়। এরপর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। নিলুফার গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখনো অপেক্ষায় আছি, সোহেল একদিন ফিরে আসবে।’
সরকারের দায়িত্ব গুমের শিকার ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা। কিন্তু সেটা না করে ভূমধ্যসাগরে সলিলসমাধি হয়েছে—দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা এমন নানা বক্তব্য দিয়ে আসল ঘটনা পাশ কাটানোর চেষ্টা করছেন।
নিলুফারের মতো অপেক্ষার প্রহর গুনছেন এখনো নিখোঁজ থাকা ব্যক্তিদের স্বজনেরা। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের (এএইচআরসি) হিসাবে, এ রকম এখনো নিখোঁজ রয়েছেন ১৫৩ ব্যক্তি। যাঁরা গত ১৩ বছরে বিভিন্ন সময়ে গুম হয়েছেন। হংকংভিত্তিক এই সংস্থা বলছে, ২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে ৬২৩ ব্যক্তি গুমের শিকার হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ৮৪ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। জীবিত অবস্থায় ফিরে এসেছেন বা পরবর্তী সময়ে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে ৩৮৩ জনকে। আর তিনজনের বিষয়ে কোনো তথ্য জানা যায়নি।
সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শুরু থেকেই গুমের বিষয়টি অস্বীকার করে আসছে। সরকারের দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে এমনও বলা হয়েছে যে এসব ব্যক্তি নিজেরাই আত্মগোপন করে আছেন, হারিয়ে গেছেন বা ভূমধ্যসাগরে সলিলসমাধি হয়েছে।
আজ ৩০ আগস্ট ‘গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে আন্তর্জাতিক দিবস’। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে ‘ইন্টারন্যাশনাল কনভেশন ফর প্রোটেকশন অব অল পার্সনস এগেইনস্ট এনফোর্স ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স’ সম্মেলনে যে আন্তর্জাতিক সনদ কার্যকর হয়, তাতে ৩০ আগস্টকে গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
বাংলাদেশের গুমের অভিযোগ একেবারে নতুন নয়। অতীতে বিভিন্ন সরকারের সময় কিছু কিছু অভিযোগ উঠেছিল। তবে ২০১২ সালে বিএনপির নেতা ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার পর বিষয়টি দেশে ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে। যদিও বিএনপির অভিযোগ, ইলিয়াস আলীর আগে বিএনপির আরেক নেতা চৌধুরী আলমকেও ঢাকা থেকে গুম করা হয়েছে।
গুমের অভিযোগ বাড়তে থাকে ২০১৩ ও ২০১৪ সালে জাতীয় নির্বাচনের আগে-পরে। বিএনপির অভিযোগ, নির্বাচন সামনে রেখে এবং নির্বাচন–পরবর্তী আন্দোলন ঠেকাতে বেছে বেছে গুরুত্বপূর্ণ নেতা-কর্মীদের তুলে নিয়ে আতঙ্ক ছড়ানো হয়েছিল। এরপর ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনের আগের তিন বছরও গুমের অভিযোগ বেশি ছিল।
শুধু বিএনপির নেতা-কর্মী নন, সংখ্যায় কম হলেও ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের নেতা এবং শ্রমিক অধিকার নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিও গুমের শিকার হয়েছেন। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে ঢাকার ভাটারা এলাকা একটি বাসা থেকে রামপুরা থানা ছাত্রলীগের নেতা মোয়াজ্জেম হোসনকে (অপু) সাদাপোশাকে তুলে নেওয়া হয়।
এএইচআরসির তথ্য বলছে, ২০০৯ সালে ৩ জন, ২০১০ সালে ১৯ জন ও ২০১১ সালে ৩২ জন গুমের শিকার হয়েছিলেন। এরপর ২০১২ সালে ২৭ জন, ২০১৩ সালে ৫৪ জন, ২০১৪ সালে ৩৯ জনের তথ্য রয়েছে। এ ছাড়া ২০১৫ সালে ৬৮ জন, ২০১৬ সালে ৯৭ জন, ২০১৭ সালে ৯০ জন এবং ৯৮ জনকে গুম করা হয়েছিল ২০১৮ সালে।
মোয়াজ্জেম একদিন ফিরে আসবেন, এখনো এই আশায় আছে তাঁর পরিবার। তাঁর বড় ভাই চিকিৎসক মঈনুল হাসান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভাইয়ের সন্ধানে মাকে নিয়ে সরকারের উচ্চ মহল থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করেছি। ভাইকে খুঁজে দিতে আবেদন জানিয়েছি। তাঁরা বলেছেন, দেখছি। কিন্তু আজও ভাইয়ের সন্ধান পাইনি। আমরা এখনো অপেক্ষায় আছি।’ তিনি জানান, তাঁর বাবা এরই মধ্যে মারা গেছেন। ছেলের চিন্তায় মা–ও অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে গেছেন।
মঈনুল হাসান বলেন, ‘রাজনৈতিক শত্রুতার জেরে আমার ভাইকে তুলে নেওয়া হয়। ভাইকে ফেরত পেলে আমরা এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ করব না।’
কোন বছরে কত গুম
মানবাধিকার সংগঠন এএইচআরসি গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশের গুম হওয়া ব্যক্তিদের নিয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে ২০০৯ থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত গুম হওয়া ব্যক্তিদের সংখ্যা তুলে ধরা হয়েছে।
এএইচআরসির তথ্য বলছে, ২০০৯ সালে ৩ জন, ২০১০ সালে ১৯ জন ও ২০১১ সালে ৩২ জন গুমের শিকার হয়েছিলেন। এরপর ২০১২ সালে ২৭ জন, ২০১৩ সালে ৫৪ জন, ২০১৪ সালে ৩৯ জনের তথ্য রয়েছে। এ ছাড়া ২০১৫ সালে ৬৮ জন, ২০১৬ সালে ৯৭ জন, ২০১৭ সালে ৯০ জন এবং ৯৮ জনকে গুম করা হয়েছিল ২০১৮ সালে।
গুমের অভিযোগগুলো নিয়ে নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানিয়ে বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক মো. নূর খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারের দায়িত্ব গুমের শিকার ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা। কিন্তু সেটা না করে ভূমধ্যসাগরে সলিলসমাধি হয়েছে—দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা এমন নানা বক্তব্য দিয়ে আসল ঘটনা পাশ কাটানোর চেষ্টা করছেন।’
জাতিসংঘের তালিকা নিয়ে কী হলো
জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ গুমের শিকার হওয়া ৭৬ জনের একটি তালিকা গত বছর বাংলাদেশ সরকারকে দেয়। গত বছরের ১৪ আগস্ট জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক তৎকালীন হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশেলেত ঢাকা সফরের সময় এ তালিকা নিয়ে সরকারের সঙ্গে কথা বলেন। মিশেল ব্যাশেলেতের সঙ্গে আলোচনায় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, ওয়ার্কিং গ্রুপ ৭৬ জনের যে তালিকা দিয়েছে, তাঁদের মধ্যে ১০ জনের খোঁজ পাওয়া গেছে। বাকিদের মধ্যে ১০ জনকে খুঁজে পেতে পুলিশ সহযোগিতা করতে চাইলেও তাঁদের স্বজনদের কাছ থেকে সাড়া পাওয়া যায়নি। বাকি ৫৬ জন ‘পলাতক’ বা নিখোঁজ।
তখন মিশেল ব্যাশেলেত ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলো সুরাহার স্বার্থে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্ত সংস্থা গঠন প্রয়োজন।
জাতিসংঘ ওই তালিকা দেওয়ার পর গত বছরের জানুয়ারিতে সেই তালিকা ধরে খোঁজখবর শুরু করে পুলিশ। তখন গুম হওয়া ব্যক্তিদের বাসায় বাসায় গিয়ে স্বজনদের জেরা করা, থানায় ডেকে পাঠানো ও সাদা কাগজে সই নেওয়ার মতো ঘটনা ঘটে বলে অভিযোগ ওঠে। তখন পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, গুমের শিকার পরিবারকে হয়রানি করতে নয়, ঘটনা তদন্তে পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে যান পুলিশের সদস্যরা।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘জাতিসংঘ থেকে একটি তালিকা দিয়েছিল। আমরা সিদ্ধান্ত নিই, তালিকায় যাঁদের নাম রয়েছে, স্থানীয় থানার ওসিদের দিয়ে সেটা যাচাই-বাছাই করা। কী ঘটনা ঘটেছে, সেটা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া। তখন পরিবারগুলো থেকে অভিযোগ করা হলো পুলিশ তাঁদের হয়রানি করছে। পরে আমরা সেটা বন্ধ করে দিলাম।’ আইনমন্ত্রী বলেন, ‘পরে সিদ্ধান্ত নিয়ে যাঁদের গুম বলা হচ্ছে, সেসব পরিবারের কাছে চিঠি দিলাম কিছু তথ্য–উপাত্ত চেয়ে। তদন্ত করে দেখার জন্য যে তাঁরা কোথায় আছেন। কিছু কিছু দেখা গেল দণ্ডাদেশ নিয়ে পলাতক রয়েছেন। অনেকে মারাও গেছেন।’
আমাদের একটাই চাওয়া, যাঁদের গুম করা হয়েছে, তাঁদের যেন ফেরত দেওয়া হয়। গুমের প্রতিটি ঘটনার তদন্ত চাই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যেসব সদস্যের বিরুদ্ধে গুমের অভিযোগ রয়েছে, তাঁদের বিচারের আওতায় আনা হোক।
জাতিসংঘের তালিকা ধরে গত বছর যে তদন্ত শুরু হয়েছিল, তার অগ্রগতি ও সর্বশেষ পুলিশের তালিকায় কতজন নিখোঁজ রয়েছেন, সেটা জানতে গতকাল পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্রের দায়িত্ব থাকা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইনামুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর কাছে এ–সংক্রান্ত কোনো তথ্য নেই।
অবশ্য ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র উপকমিশনার ফারুক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, জাতিসংঘের তালিকা ধরে পুলিশের তদন্ত অব্যাহত রয়েছে। তদন্তে পুলিশ জেনেছে, তালিকায় যাঁদের গুম বলা হচ্ছে, তাঁদের অনেকেই বিদেশে অবস্থান করছেন। কেউ ব্যবসা করছেন। আবার কেউ কেউ বিদেশে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় চাইছেন।
গুমের শিকার ব্যক্তিদের নিয়ে সরকার বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এমন বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছেন ‘মায়ের ডাক’–এর সমন্বয়কারী সানজিদা ইসলাম। যাঁদের পরিবারের সদস্যকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, এমন পরিবারগুলোকে নিয়ে মায়ের ডাক নামের একটি সংগঠন গড়ে তোলা হয়েছে।
সানজিদা ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, গুম হওয়া মানুষগুলো কোথায় আছেন, তার কোনো স্পষ্ট উত্তর দেয় না সরকার। তাঁদের নিয়ে ঠাট্টা করে বক্তব্য দেওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘আমাদের একটাই চাওয়া, যাঁদের গুম করা হয়েছে, তাঁদের যেন ফেরত দেওয়া হয়। গুমের প্রতিটি ঘটনার তদন্ত চাই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যেসব সদস্যের বিরুদ্ধে গুমের অভিযোগ রয়েছে, তাঁদের বিচারের আওতায় আনা হোক।’
No comments: